স্বাস্থ্য অর্থায়ন: সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে বড় বাধা ফি
স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে যেন মানুষের কষ্ট না হয় এবং সব মানুষ যেন স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে, তার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব সদস্যদেশ অঙ্গীকার করেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ রেজুলেশনের নম্বর হচ্ছে ৫৮ দশমিক ৩৩। এই রেজুলেশনের মূল কথা হচ্ছে, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগীর কাছ থেকেই অর্থ নিয়ে চিকিৎসা করা অমানবিক হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্বাস্থ্য অর্থায়নের নতুন পথ খুঁজতে হবে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা পেতে গিয়ে রোগীর কষ্ট না হওয়া এবং সবাই স্বাস্থ্যসেবা পাবে কি না, তা এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন। চিকিৎসক, নার্স, ওষুধ ও হাসপাতাল—সবকিছুতেই টাকার প্রয়োজন আছে। এভাবে খরচের একটি হিসাব করে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী এই খরচের পরিমাণ বছরে ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এই খরচের পরিমাণ ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে না। অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য নিত্যনতুন ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, উন্নত দেশগুলো স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু খরচ বেশি করতে পারে, আর গরিব দেশ তা পারে না। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড কো-অপারেশনভুক্ত (ওইসিডি) ধনী দেশের মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা খরচ বছরে চার হাজার ডলার (দুই লাখ ৮৪ হাজার টাকা) ও থাইল্যান্ডে মাত্র ১৩৬ ডলার (নয় লাখ ৬৫৬ টাকা)। ধনী ও উন্নয়নশীল দেশের পার্থক্য এত বিশাল। বাংলাদেশের কথা এখন না-ই তুললাম।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য অর্থায়ন আসলে কী? এটা কি শুধু স্বাস্থ্যসেবার জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যাপার, নাকি কে এই অর্থ দেবে, কেমন করে দেবে ইত্যাদি বিষয় ঠিক করা? সাধারণত রাজস্ব খাত থেকে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা সব সময় পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, এই নীতিতে বিশ্বাস করলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি পদে সেবার বিনিময়ে মূল্য ধার্য করা হচ্ছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ইউজার ফি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারকারী সরাসরি নির্ধারিত খরচ বহন করবে। এক হিসেবে স্বাস্থ্য পণ্য হিসেবে বিক্রয় করার মতো ব্যাপার। টাকা দিয়ে কিনতে পারলে সেবা পাবে, নইলে পাবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, ইউজার ফি বা সরাসরি দাম (ডিরেক্ট পেমেন্ট) দিয়ে সেবা কেনা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যখন কোনো রোগী অসুস্থতায় ভুগছে, তখন তাকে প্রতিটি সেবা পাওয়ার জন্য যদি দাম দিতে হয়, তাহলে সে যতটুকু দাম দিতে সক্ষম, শুধু ততটুকুই নেবে। ফলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকতে পারে এবং সেবা নেওয়া বিলম্বিত হতে পারে। সরাসরি দাম দেওয়ার নিয়মটি সরকার করতে পারে, কিংবা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও করতে পারে। বাংলাদেশে উভয় ঘটনাই ঘটছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) মানুষ কোনো প্রকার স্বাস্থ্য গ্রহণ করছে না, কারণ তাদের সেবা কেনার সামর্থ্য নেই। অর্থাৎ বিনা চিকিৎসায় রয়েছে, একসময় হয়তো মারাও যাচ্ছে। আবার চিকিৎসা না নিতে পারার কারণে অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছে এবং তারা কাজও করতে পারছে না, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের দরিদ্রতা আরও বাড়ছে।
বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্যসেবার খরচ বহন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও অন্যান্য জরুরি খরচ মেটানোর পর মোট আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবায় খরচ হয়ে যায়। কিছু কিছু দেশে মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ প্রতিবছর চিকিৎসাসেবার খরচ বহন করার কারণে মারাত্মক আর্থিক সংকটের শিকার হয় এবং ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের খাতায় নতুন করে যুক্ত হয়। কেনিয়া ও সেনেগালের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছরে এক লাখ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে চিকিৎসার খরচ মেটানোর কারণে। দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই লাখ ৯০ হাজার পরিবার একই কারণে এ অবস্থার শিকার হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ১৫ কোটি মানুষ মারাত্মক আর্থিক সংকটের অবস্থায় পড়ে যায়, আর প্রায় ১০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় শুধু স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অর্থায়নের নিয়মের কারণে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া কোনোমতেই কাম্য নয়।
স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য সরাসরি মূল্য দেওয়া বা ইউজার ফির বিষয়টি শুধু দামি চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে তা ঘটছে এমন নয়, বরং অল্প অল্প করে বারবার খরচ করতে গিয়েও মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, কোনো পরিবারে শুধু ১০০ টাকার জন্য বিরাট সমস্যা হতে পারে, কারও বেলায় ১০ হাজার টাকা, কিংবা আরও বেশি টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই চিকিৎসা খরচ তার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে ইউজার ফির যে হার নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী রোগী ভর্তির টিকিট থেকে শুরু করে রোগ অনুযায়ী নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে প্রথমেই হাজার টাকা খসে পড়বে। কোনো গরিব মানুষের পক্ষে একবারে চিকিৎসার জন্য এত টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় থেকে অর্ধেক চিকিৎসা করে প্রায় আট-দশ হাজার টাকা খরচ করে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে, কারণ ইউজার ফির নিয়ম অনুযায়ী তাদের পক্ষে চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব নয়। এই অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তারা এরই মধ্যে গরু কিংবা ছাগল বিক্রি করে ফেলেছে।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে যারা চিকিৎসা খরচ বহন করতে আর্থিকভাবে সক্ষম, তাদের কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা দিতে পারে, তাদের অহেতুক নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে খরচ করানো হয়, অন্যদিকে যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের চিকিৎসাই হয় না। এটা চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করছে।
বিশ্বের অনেক দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য অর্থায়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। চীন সরকার ১৯৭৮ সালে বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবার ঘোষণা দিয়েছিল, যাতে সরাসরি মূল্য দেওয়ার পরিমাণ ১৯৮০ সালে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০০০ সালে ৬০ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল, যার কারণে জনগণের একটি বড় অংশ আর্থিক সংকটের শিকার হয়েছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁদের খরচ তুলতে গিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার চেয়ে ওষুধ লিখে দেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিতেন, যার কারণে স্বাস্থ্যসেবার মান খুব কমে গিয়েছিল। চীন সরকার ২০০৯ সালে ইউজার ফি নেওয়ার পরিবর্তে স্বাস্থ্য বিমার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে চীনের শতভাগ মানুষকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় এনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালের মধ্যে বিমাবিহীন তিন কোটি ২০ লাখ মানুষকে বিমার আওতায় আনা হবে। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো গরিব ও নিম্নবিত্তদের বিমার সেবা দিতে আস্বীকার করতে পারবে না।
স্বাস্থ্যসেবার জন্য অর্থায়নের চিন্তাভাবনা জরুরি বিষয়, কিন্তু এর দায় কার ওপর চাপানো হচ্ছে, সেটাই আসল প্রশ্ন। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৫ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য সব মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে কোনো মানুষ যেন আর্থিক সংকটে না পড়ে, তার দিকে নজর রাখতে হবে। বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অর্থায়ন করতে গিয়ে ইউজার ফি নেওয়ার মতো ব্যবস্থা করলে এ দুই উদ্দেশ্যের একটিও সফল হবে না।
স্বাস্থ্য অর্থায়নের জন্য সরকারকে রাজস্ব খাতের পাশাপাশি ট্যাক্স, বিমা কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন। চিকিৎসক, নার্স, ওষুধ ও হাসপাতাল—সবকিছুতেই টাকার প্রয়োজন আছে। এভাবে খরচের একটি হিসাব করে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী এই খরচের পরিমাণ বছরে ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এই খরচের পরিমাণ ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে না। অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য নিত্যনতুন ওষুধ ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, উন্নত দেশগুলো স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু খরচ বেশি করতে পারে, আর গরিব দেশ তা পারে না। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড কো-অপারেশনভুক্ত (ওইসিডি) ধনী দেশের মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা খরচ বছরে চার হাজার ডলার (দুই লাখ ৮৪ হাজার টাকা) ও থাইল্যান্ডে মাত্র ১৩৬ ডলার (নয় লাখ ৬৫৬ টাকা)। ধনী ও উন্নয়নশীল দেশের পার্থক্য এত বিশাল। বাংলাদেশের কথা এখন না-ই তুললাম।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য অর্থায়ন আসলে কী? এটা কি শুধু স্বাস্থ্যসেবার জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যাপার, নাকি কে এই অর্থ দেবে, কেমন করে দেবে ইত্যাদি বিষয় ঠিক করা? সাধারণত রাজস্ব খাত থেকে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা সব সময় পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, এই নীতিতে বিশ্বাস করলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি পদে সেবার বিনিময়ে মূল্য ধার্য করা হচ্ছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ইউজার ফি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারকারী সরাসরি নির্ধারিত খরচ বহন করবে। এক হিসেবে স্বাস্থ্য পণ্য হিসেবে বিক্রয় করার মতো ব্যাপার। টাকা দিয়ে কিনতে পারলে সেবা পাবে, নইলে পাবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, ইউজার ফি বা সরাসরি দাম (ডিরেক্ট পেমেন্ট) দিয়ে সেবা কেনা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। যখন কোনো রোগী অসুস্থতায় ভুগছে, তখন তাকে প্রতিটি সেবা পাওয়ার জন্য যদি দাম দিতে হয়, তাহলে সে যতটুকু দাম দিতে সক্ষম, শুধু ততটুকুই নেবে। ফলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকতে পারে এবং সেবা নেওয়া বিলম্বিত হতে পারে। সরাসরি দাম দেওয়ার নিয়মটি সরকার করতে পারে, কিংবা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও করতে পারে। বাংলাদেশে উভয় ঘটনাই ঘটছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) মানুষ কোনো প্রকার স্বাস্থ্য গ্রহণ করছে না, কারণ তাদের সেবা কেনার সামর্থ্য নেই। অর্থাৎ বিনা চিকিৎসায় রয়েছে, একসময় হয়তো মারাও যাচ্ছে। আবার চিকিৎসা না নিতে পারার কারণে অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছে এবং তারা কাজও করতে পারছে না, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের দরিদ্রতা আরও বাড়ছে।
বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্যসেবার খরচ বহন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও অন্যান্য জরুরি খরচ মেটানোর পর মোট আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবায় খরচ হয়ে যায়। কিছু কিছু দেশে মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ প্রতিবছর চিকিৎসাসেবার খরচ বহন করার কারণে মারাত্মক আর্থিক সংকটের শিকার হয় এবং ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের খাতায় নতুন করে যুক্ত হয়। কেনিয়া ও সেনেগালের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছরে এক লাখ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে চিকিৎসার খরচ মেটানোর কারণে। দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই লাখ ৯০ হাজার পরিবার একই কারণে এ অবস্থার শিকার হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ১৫ কোটি মানুষ মারাত্মক আর্থিক সংকটের অবস্থায় পড়ে যায়, আর প্রায় ১০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় শুধু স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অর্থায়নের নিয়মের কারণে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া কোনোমতেই কাম্য নয়।
স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য সরাসরি মূল্য দেওয়া বা ইউজার ফির বিষয়টি শুধু দামি চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে তা ঘটছে এমন নয়, বরং অল্প অল্প করে বারবার খরচ করতে গিয়েও মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, কোনো পরিবারে শুধু ১০০ টাকার জন্য বিরাট সমস্যা হতে পারে, কারও বেলায় ১০ হাজার টাকা, কিংবা আরও বেশি টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই চিকিৎসা খরচ তার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে ইউজার ফির যে হার নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী রোগী ভর্তির টিকিট থেকে শুরু করে রোগ অনুযায়ী নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে প্রথমেই হাজার টাকা খসে পড়বে। কোনো গরিব মানুষের পক্ষে একবারে চিকিৎসার জন্য এত টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় থেকে অর্ধেক চিকিৎসা করে প্রায় আট-দশ হাজার টাকা খরচ করে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে, কারণ ইউজার ফির নিয়ম অনুযায়ী তাদের পক্ষে চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব নয়। এই অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তারা এরই মধ্যে গরু কিংবা ছাগল বিক্রি করে ফেলেছে।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে যারা চিকিৎসা খরচ বহন করতে আর্থিকভাবে সক্ষম, তাদের কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা দিতে পারে, তাদের অহেতুক নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে খরচ করানো হয়, অন্যদিকে যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের চিকিৎসাই হয় না। এটা চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করছে।
বিশ্বের অনেক দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য অর্থায়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। চীন সরকার ১৯৭৮ সালে বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবার ঘোষণা দিয়েছিল, যাতে সরাসরি মূল্য দেওয়ার পরিমাণ ১৯৮০ সালে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০০০ সালে ৬০ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল, যার কারণে জনগণের একটি বড় অংশ আর্থিক সংকটের শিকার হয়েছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁদের খরচ তুলতে গিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার চেয়ে ওষুধ লিখে দেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিতেন, যার কারণে স্বাস্থ্যসেবার মান খুব কমে গিয়েছিল। চীন সরকার ২০০৯ সালে ইউজার ফি নেওয়ার পরিবর্তে স্বাস্থ্য বিমার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে চীনের শতভাগ মানুষকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় এনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালের মধ্যে বিমাবিহীন তিন কোটি ২০ লাখ মানুষকে বিমার আওতায় আনা হবে। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো গরিব ও নিম্নবিত্তদের বিমার সেবা দিতে আস্বীকার করতে পারবে না।
স্বাস্থ্যসেবার জন্য অর্থায়নের চিন্তাভাবনা জরুরি বিষয়, কিন্তু এর দায় কার ওপর চাপানো হচ্ছে, সেটাই আসল প্রশ্ন। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৫ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য সব মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে এবং স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে কোনো মানুষ যেন আর্থিক সংকটে না পড়ে, তার দিকে নজর রাখতে হবে। বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অর্থায়ন করতে গিয়ে ইউজার ফি নেওয়ার মতো ব্যবস্থা করলে এ দুই উদ্দেশ্যের একটিও সফল হবে না।
স্বাস্থ্য অর্থায়নের জন্য সরকারকে রাজস্ব খাতের পাশাপাশি ট্যাক্স, বিমা কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
Source: http://www.prothom-alo.com
No comments:
Post a Comment