সন্ধানী মানুষের পাশে তারুণ্য
০০ ইকবাল খন্দকার ০০
একজন মুমূষর্ু রোগীর কাছে এক ব্যাগ রক্ত পৃথিবীর যেকোনো মূল্যবান জিনিসের চেয়েও বেশি মূল্যবান। কারণ, একমাত্র এই রক্তই পারে আবার তাকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে। ফিরিয়ে দিতে হাসি-আনন্দ। কিন্তু চরম প্রয়োজনের সময় নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্ত পাওয়া অনেকটাই দুষ্কর। এই দুষ্কর কাজটিই করে চলেছে সন্ধানী। তরুণদের পরিচালিত এই মানবসেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি নানাভাবে রক্ত সংগ্রহ করে সেই রক্ত বিলিয়ে যাচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের মধ্যে। প্রতিবছর বইমেলা, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানকে তারা বেছে নেয় রক্ত সংগ্রহের জন্যে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে তারা চালিয়ে যায় রক্ত সংগ্রহের এই কঠিন কাজটি। অনুষ্ঠানে আগন্তুক তরুণদের তারা বুঝিয়ে বলে রক্ত দানের সুবিধার কথা, গুরুত্বের কথা। কেউ তাদের কথা শোনে, কেউ কেউ কোনো পাত্তা না দিয়ে চলে যায়। তবু হতাশ হয় না তারা। আবার এমন কিছু কিছু তরুণকে পাওয়া যায়, যারা এবার না দিলেও পরবতর্ীতে রক্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়। এমনকি দেয়ও। এভাবেই চলছে। যেসব তরুণ এই জনকল্যাণমূলক কাজটি করে যাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য একটিই_গরীব মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সন্ধানীর সঙ্গে যুক্ত তরুণরা যে কেবল অন্যদের রক্তই সংগ্রহ করে, তা কিন্তু না। বরং নির্দিষ্ট একটা ব্যবধানে নিজেরাও নিয়মিত রক্ত দান করে। নিজেদের রক্ত এবং সংগ্রহকৃত রক্ত_সব মিলিয়ে মোটামুটি সবার চাহিদাই পূরণ করতে পারে তারা। যে কারণে সন্ধানীর কাছে রক্তের জন্যে এলে কাউকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় না। তারই ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত সন্ধানী ৬ লাখ ২৬ হাজারেরও বেশি রক্তের ব্যাগ সংগ্রহ ও সরবরাহ করেছে। এখন সন্ধানীর কাজ শুধু রক্ত দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই সীমানাকে ছাড়িয়ে তারা এখন অন্ধ মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্নও দেখে চলেছে। সন্ধানীর কাছে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৬ হাজার ৩২ জন মানুষ মরণোত্তর চক্ষুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর প্রায় ৩ হাজার মানুষকে অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দেখিয়েছে এ পৃথিবীর আলো, আপনজনদের মুখ। মানুষের সেবায় নিবেদিত এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে ১৯৭৭ সালে। যাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, তারা সবাই ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তারা সংখ্যায় ছিলেন ছয় জন। এই ছয়জনের মধ্যে একজন ছিলেন হতদরিদ্র। এতোটাই দরিদ্র ছিলেন যে, কোনো কোনো দিন নাশতা করার টাকাটাও থাকতো না তার হাতে। কি আর করবেন, নাশতা না করেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস করতেন একটানা। তার এই কষ্ট দেখে খুব দুঃখ পেলেন বাকি পাঁচজন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, সবাই পাঁচ টাকা করে দিয়ে তাদের এই বন্ধুটির নাশতার ব্যবস্থা করবেন। পরদিন থেকেই তারা তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করলেন। এভাবে চললো এক বছর। তারপর তারা ঠিক করলেন, নিজেদের জন্যেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। এরই মধ্যে বস্নাড ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে তারা জানতে পারলেন, কিভাবে দেশের বাইরের বস্নাড ব্যাংকগুলো কাজ করে আর কেনই বা দেশের হাজার হাজার রোগী রক্তের জন্যে পেশাদার রক্তদাতাদের উপর নির্ভরশীল। এর জন্যে তারা একটি স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করার উদ্যোগ নেন। সেখান থেকেই শুরু। এরপর ২ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে সন্ধানী। বর্তমানে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ইউনিট মিলে সন্ধানীর মোট ১৮টি ইউনিট রয়েছে। সন্ধানীর সদস্য হওয়ার জন্যে শর্ত হলো, তাকে মেডিকেল কলেজের ছাত্র হতে হবে। আর যে রক্ত দিতে চান, সে তিন মাস পরপরই সন্ধানীতে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসতে পারেন। একবার রক্ত দিলেই তারা সন্ধানীর ডোনার সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। এই ডোনার সদস্য তার নিজের প্রয়োজনে রক্ত নিতেও পারবেন। তাই আর দেরি নয়, মানবতার সেবার লক্ষ্যে আজই সন্ধানীর ডোনার সদস্য হিসেবে নাম লিপিবদ্ধ করুন। আর গড়ে তুলুন রক্তের বন্ধন। যে বন্ধন আমাদের মাঝে তৈরি করবে ভালোবাসা আর সমপ্রীতির সেতু।
No comments:
Post a Comment